বঙ্গোপসাগরীয় শাখাঃ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখার একটি শাখা দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে সোজা পূর্বদিকে মায়ানমারের আরাকান উপকূলে প্রবাহিত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় । পরে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমি তে প্রবেশ করে ।বঙ্গোপসাগরীয় মৌসুমী বায়ুর অপর একটি শাখা পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের উপর দিয়ে এসে মেঘালয় খাসিয়া পাহাড়ের ও পূর্ব হিমালয় প্রতিহত হয় সেখানে বৃষ্টিপাত ঘটায় ।
প্রচুর জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু প্রথমে খাসিয়া পাহাড়ের বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হঠাৎ প্রায় 1200 মিটার উপরে উঠে যায় এবং সেখানে শীতল বায়ু সংস্পর্শে ঘনীভূত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় । সেই জন্য খাসিয়া পাহাড়ের চেরাপুঞ্জির কাছে মৌসিনরাম নামক এক গ্রামে বিশ্বের সর্বাধিক (গড়ে ১২০০-১৪০০ সেমি) বৃষ্টিপাত হয় কিন্তু চেরাপুঞ্জির বিপরীতে অবস্থিত শিলং শহর বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল এ অবস্থিত বলে সেখানে মাত্র ২২৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয় ।
বঙ্গোপসাগরীয় মৌসুমী বায়ুর এই শাখা আরো উত্তরে গিয়ে অতুচ্চ হিমালয় পর্বত অতিক্রম করতে না পেরে হিমালয় বাধা পেয়ে দুটি অংশে বিভক্ত হয় । একটি অংশে পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত (২৫০-৩০০ সেমি )ঘটায় । অপরাহ্ন অপর অংশ পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ , পশ্চিমবঙ্গ বিহার , উত্তর প্রদেশ , পাঞ্জাব এবং হিমালয়ের পাদদেশের তরাই অঞ্চলের বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ক্রমশ পশ্চিমে অবসর হয় । এই বায়ুপ্রবাহ পশ্চিমে যতই অগ্রসর হয় এর জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ততই কমতে থাকে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে যায়। আবার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পশ্চিম হিমালয়ের পাদদেশে অঞ্চল থেকে দক্ষিনে ক্রমশ কমতে থাকে। যখন রাজস্থানের মরু অঞ্চলের কাছাকাছি এসে পৌঁছায় তখন এই বায়ুতে জলীয়বাষ্প থাকে না এবং থাকলেও এই অঞ্চলে অধিক উষ্ণতায় জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন ঘটে না । তাই এখানে বৃষ্টিপাত হয় না ।
শরৎ ঋতু বা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাগমনঃ
আরব সাগরীয় ও বঙ্গোপসাগরীয় মৌসুমী বায়ু দুটি অক্টোবর মাস থেকেই উত্তর ভারত থেকে প্রত্যাগমন করতে থাকে । এই সময় সূর্য নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে ক্রমশঃ দক্ষিণে মকর ক্রান্তি রেখার দিকে যেতে থাকে । অর্থাৎ 21 শে জুনের পর থেকে দক্ষিণায়ন শুরু হয় এবং সূর্যের দক্ষিণায়নের সাথে সাথে সর্বোচ্চ উষ্ণ অঞ্চল উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের দিকে সরতে থাকে। ফলে উত্তর ভারতে বিশেষ করে পাঞ্জাব অঞ্চলের বায়ু ক্রমশঃ শীতল হয়ে ধীরে ধীরে উচ্চ চাপ সৃষ্টি হয় । উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নির্গত বায়ুর দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
সূর্যের দক্ষিণায়নের সাথে সাথে ভারতের শীতের তীব্রতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং পাঞ্জাবের উচ্চচাপ বলয়ের শক্তিও ক্রমশ বাড়তে থাকে । ফলে পাঞ্জাবের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নির্গত বায়ু অধিক শক্তি সম্পন্ন হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ুকে ক্রমশ পশ্চাৎ অপসারণ করতে বাধ্য করে এবং দেশের অভ্যন্তর ভাগ থেকে উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ু রূপে প্রবাহিত হয়। আরব সাগরীয় শাখা রাজস্থান থেকে গুজরাটে প্রত্যাগমন করে এবং সেখান থেকে আরও পরে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক অঞ্চল ত্যাগ করে। বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাঞ্জাব ত্যাগ করে এবং অক্টোবর নাগাদ গাঙ্গেয় সমভূমির উপর দিয়ে প্রথমে পূর্ব দিকে এবং বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পশ্চাৎ অপসারণ করে থাকে । সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পাঞ্জাবের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নির্গত বায়ুর সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় । তাকে আশ্বিনের ঝড় বলা হয় ।
ভারতের বৃষ্টিপাত অঞ্চল বৃষ্টিপাতের তারতম্য অনুযায়ী ভারতকে কয়েকটি বৃষ্টিপাত অঞ্চলে ভাগ করা যায় । যথাঃ ১) অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলঃ মেঘালয় সহ উত্তর ভারতের পাহাড়ি রাজ্যসমূহ আসাম, পূর্ব হিমালয় ও তরাই , পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পূর্বাঞ্চল , উত্তর বিহার এবং আরব সাগরের তীরবর্তী পশ্চিম উপকূল এই অঞ্চলের অন্তর্গত । এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আড়াইশো সেন্টিমিটারের বেশি। তবে কোনো কোনো স্থানে 500 সেন্টিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয় ।
২) মাঝারি বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলঃ পশ্চিমবঙ্গের মধ্য ও দক্ষিণ ভাগ, বিহার ,ঝাড়খন্ড , উড়িষ্যার পূর্বাংশ, উত্তরপ্রদেশের উত্তরাংশ , অন্ধ্র ও তামিলনাড়ু উপকূলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 125 থেকে 250 সেন্টিমিটার এর মধ্যে ।
৩) স্বল্প বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলঃ উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ , দাক্ষিণাত্য মালভূমির মধ্যভাগ , পূর্ব পাঞ্জাব ও হরিয়ানা এবং পূর্ব রাজস্থান এই অঞ্চলের অন্তর্গত । এই অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হয় 75 সেন্টিমিটার থেকে 125 সেন্টিমিটার এর মধ্যে ।
৪) অতি স্বল্প বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলঃ রাজস্থানের বেশিরভাগ অঞ্চল ,পাঞ্জাবের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ , হরিয়ানার পশ্চিমাংশ, জম্মু-কাশ্মীরের দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশ , গুজরাটের উত্তর-পশ্চিমাংশ এই অঞ্চলের অন্তর্গত । এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 25 থেকে 75 সেন্টিমিটার এর মধ্যে ।
৫) বিরল বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলঃ রাজস্থানের পশ্চিমাংশের মরু অঞ্চল, জম্মু-কাশ্মীরের উত্তর-পূর্বাংশ প্রভৃতি এই অঞ্চলের অন্তর্গত । এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 25 সেন্টিমিটারের ও কম।
ভারতে প্রায়ই খরা ও বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা যায় । এর কারণগুলো হলোঃ (১) যেহেতু ভারত মৌসুমী বায়ুর প্রভাব এর অধীন একটি দেশ , তাই এদেশে প্রধানত মৌসুমী বায়ুর দ্বারা বৃষ্টিপাত ঘটে । দেশের মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় 90% দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দ্বারা ঘটে থাকে । কিন্তু এই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন খুবই অনিশ্চিত কারণ প্রতিবছর সমান পরিমাণ জলীয়বাষ্প নিয়ে আসে না । তাই প্রতিবছর সমান বৃষ্টিপাত হয় না। কোন বছর নির্দিষ্ট সময়ের আগে আসে এবং কোন সময় নির্দিষ্ট সময়ের পরে আসে । ফলে স্বাভাবিকভাবে অনাবৃষ্টি বা খরার প্রাদুর্ভাব যেমন দেখা দেয় তেমনি অতিবৃষ্টি ও বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ।
(২) বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা হেতু উষ্ণতার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ঘটে, তাই খরার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায় । তেমনি ভারতের নদীগুলোর গভীরতা হ্রাস পাওয়ায় একটু বেশি বৃষ্টিপাত হলে নদী দ্বারা বাহিত জলের পরিমাণ সমান না হওয়ায় এবং নদীর জল ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় নদীর দু'কূল ছাপিয়ে প্লাবন বা বন্যার সৃষ্টি করে ।
ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবঃ স্থলবায়ু ও সমুদ্র বায়ুর ব্যাপক সংস্করণ হলো মৌসুমী বায়ু । উষ্ণতার তারতম্যের বায়ুচাপের তারতম্যের জন্য যেমন স্থলবায়ু ও সমুদ্র বায়ু সৃষ্টি হয় তেমনি মৌসুমী বায়ু সৃষ্টি হয় । ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাই ভারতকে মৌসুমী বায়ুর দেশ বলা হয়ে থাকে। ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ু নানান প্রভাব বিস্তার করে। যেমন বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী বায়ু যেমনঃ বর্ষাকালে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু, শরৎকালের প্রত্যাগমনকারী মৌসুমী বায়ু এবং শীতকালে উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ু দ্বারা ভারতের সর্বত্র বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয় ।
দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে সমুদ্রের উপর দিয়ে আগত মৌসুমী বায়ুতে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকে। এই বায়ু পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চলে, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে বাধা পেয়ে বর্ষাকালে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় ।
শীতকালীন সময়ে উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারতে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না । তবে মাঝে মাঝে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট স্থানীয় নিম্নচাপের জন্য পূর্ব উপকূলে বৃষ্টিপাত হয় এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে পশ্চিমী ঝামেলার প্রভাবে স্বল্প পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু যখন গ্রীষ্মকালে ভারতে প্রবেশ করে তখন ওই বায়ু জলীয় বাষ্পপূর্ণ থাকায় সেই সময়কার জলবায়ু আদ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু শরৎকালের প্রত্যাগমন কালে ভারতে জলীয় বাষ্প বিশেষ না থাকায় জলবায়ু অনেকটা শুষ্ক প্রকৃতির হয়।
আমাদের সাথে facebook page এ যুক্ত থাকতে এই লিঙ্কে click করুন
Please do not enter any spam link in the comment box